যশোরে দেড় মাসে ১১ খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই চুরিসহ অপরাধ বাড়ছেই

আরো পড়ুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর শহরের রেলস্টেশন এলাকা। তিনজন যুবক দৌঁড়ে দৌঁড়ে একজনকে মারছে। দুই জনের হাতের রয়েছে চাকু। তারা এলোপাতাড়ি ছুরি চালিয়ে জখম করছে। পরে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে আহত জীবন বাঁচানোর তাগিদে দৌঁড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে দৌঁড়াতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। পথচারীরা ছুরিকাঘাত ঐ যুবককে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলছে। সিসি ক্যামেরাতে ধরা পড়া নির্মম এই হত্যাকান্ডটি ঘটে শনিবার সন্ধ্যায় যশোর স্টেশনের দ্বিতীয় প্লাটফর্মে। এর আগের দিন শুক্রবার সকালে শহরতলীর বালিয়াডাঙ্গা মানদিয়া জামে মসজিদের পেছনে একটি পরিত্যক্ত স্থান থেকে আগুনে পোড়া এক ব্যক্তির (৪০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, হত্যার পর পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঔ ব্যক্তির মুখ। অপরাধমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডের এই চিত্র যেন যশোরে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। শহরে হঠাৎ চুরি, ছিনতাই, খুনোখুনি বেড়েছে। প্রকাশ্যে দিনদুপুরে ঘটছে খুনের ঘটনা। গ্রুপে-গ্রুপে দ্বন্দ্ব, মাদক-চাঁদাবাজি ও অস্ত্র বিক্রিসহ নানা কারণে ঘটছে হত্যাকাণ্ড। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, চলতি বছরের দেড় মাসে ১১ টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। একই সাথে চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, অর্ধডজন ছুরিকাহত, ছিনতাই ও চুরিসহ অসংখ্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। অপরাধ কর্মকাণ্ডে বেড়েছে চাকু, ছুরি ও ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা।baa84042436432765e5d81ec0331a42c 63a67a8386b10

এই বিষয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, যশোরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রধান কারণ কিশোর গ্যাংয়ের কারণে। বছর খানিক আগে প্রশাসনকে সর্তক করেছিলাম কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করার। এখন সেই কিশোর গ্যাং ভয়বহ ধারণ করেছে; প্রতিদিন হত্যাকান্ড, ছুরিকাঘাত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব কিশোর গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণ করছেন আমাদের ক্ষমতাধীন দলের নেতাকর্মীরা। আর এসবের মূলে রয়েছে মাদক বেঁচকেনা। দ্রুত এই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এই শহরে বসাবস করা কঠিন হয়ে যাবে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত রোববার রাত পৌনে ১০টার দিকে যশোরের অভয়নগরে যুবলীগ নেতা মুরাদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার নওয়াপাড়া বেঙ্গল মিল গেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মুরাদ হোসেন নওয়াপাড়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর বাবার নাম সাহাবুদ্দিন।

WhatsApp Image 2024 02 10 at 8.23.11 PM
গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে যশোর রেলস্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে মো. জুম্মান (২৬) এক যুবক নিহত হয়। নিহত জুম্মান শহরের শংকরপুর এলাকার মুরাদ হোসেনের ছেলে। এলাকায় সন্ত্রাসীদের তালিকায় নিহত জুম্মানের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, রেলস্টেশনের উল্টো দিকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন জুম্মান। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাঁর বাঁ পায়ের ঊরুতে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে আহত জুম্মানকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় রবিবার দুপুর পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি বা পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।

শুক্রবার সকালে যশোর শহরতলীর বালিয়াডাঙ্গা মানদিয়া জামে মসজিদের পেছনে একটি পরিত্যক্ত স্থান থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। এ সময় তাঁর মুখ থেকে পেট পর্যন্ত আগুনে পোড়া ছিল। নিহত ব্যক্তির নাম মহসিন হোসেন (৪০)। তিনি যশোর সদরের নুরপুর গ্রামের মছি মণ্ডলের ছেলে। পুলিশ বলছে, মহসিন সুদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষরা তাঁকে হত্যা করতে পারেন। এই ঘটনায় জড়িতদের চিন্হত বা কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২৬ জানুয়ারি যশোর শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সোলায়মান হোসেনকে। এলাকায় মাদকের কারবার এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন সোলায়মান। সূত্র মতে, ঘটনারদিন ২৬ জানুয়ারি মাদক কারবারিরা প্রথমে সোহাগকে খোঁজ করে। তাকে না পেয়ে তার ভাই জসিম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা করে। জসিমকে ঠেকাতে গিয়ে হত্যাকান্ডের শিকার হন সোলায়মান। নিহত সোলায়মান শহরের টিবি ক্লিনিক এলাকার আব্দুল হকের ছেলে।

১৩ জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে শহরের খড়কিতে শিশু আয়শা মারিয়ামকে মারপিট করে তার সৎ মা পারভীন খাতুন। মারপিটে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আয়শা। এরপরে তাকে উদ্ধার করে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিছুক্ষণ পরে আয়শাকে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। খবর পেয়ে থানা পুলিশ হাসপাতাল থেকে তার সৎ মা পারভীন খাতুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। ওইদিন জিজ্ঞাসাবাদে কোন ভাবেই আয়শাকে হত্যার কথা স্বীকার করেনি পারভীন খাতুন। কিন্তু ঘটনার দু’দিন পরই তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে পারভীনকে আটক করে পুলিশ। মৃত আয়শার বাবা পিন্টু মিয়া এবং সৎ মা পারভীন খাতুন খড়কি ধোপাড়ার একটি ভাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন।

১৯ জানুয়ারি রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে মাংস ব্যবসায়ী রিপন হোসেন দিপু নামে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে সহযোগী অপর তিন ব্যবসায়ী। এই ঘটনায় ৫জনের নামে থানায় মামলা হলেও রানা হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে অন্য আসামিরা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থেকে পুলিশি আটকের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। নিহত দিপু ওই এলাকার রফিকুল ইসলাম মনুর ছেলে।

এ বিষয়ে যশোর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন দাবি করেন, অন্য সময়ের চেয়ে যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। সেসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে সেটা পারিবারিক কলহের জের ধরে। হত্যাকান্ডের পর জড়িতদের আটক করা হচ্ছে। আর কিছু ঘটনায় দফায় দফায় পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, তবে ঘটনার পরপরই আত্মগোপনে গিয়ে আটক এড়িয়ে চলছে। আবার অনেক পলাতক আসামির পরিবারের পক্ষে বাদী পরিবারে সাথে দেনদরবার চালাচ্ছে

হত্যাকান্ডে অধিকাংশ আসামিই আটকের বাইরে

যশোরে ১১টি হত্যাকান্ডে অধিকাংশ আসামিই আটকের বাইরে রয়েছে। এছাড়া ছিনতাই-ছুরিকাঘাতের ঘটনায় পুলিশের দাবি, দফায় দফায় অভিযান চলছে, তবে ঘটনার পরপরই আত্মগোপনে গিয়ে আটক এড়িয়ে চলছে। আবার অনেক পলাতক আসামির পরিবারের পক্ষে বাদী পরিবারে সাথে দেনদরবার চালাচ্ছে। আসামি আটক না হওয়া এবং তাদের পক্ষে তদবির শুরু হওয়ার ঘটনায় হতাশা উৎকণ্ঠায় সময় কাটছে স্বজনদের। যদিও পুলিশের দাবি অভিযান চলমান রয়েছে।

একেএকে সবাই আটক হবে। আরবপুরে মালেক হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই একরামুল হুদা জানিয়েছেন, মামলার পলাতক ও আত্মগোনে যাওয়া ৪ আসামিকেই খোঁজা হচ্ছে, কৌশলী অভিযানও চলছে। দু’একদিনের মধ্যেই সবাই আটক হবে। এছাড়া এর আগে আটক আলিমকে রিমান্ডে আনলে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে, যা যাচাই বাছাই চলছে। শেখহাটির দিপু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই একরামুল হুদা জানিয়েছেন, মামলাটির তদন্ত ও আটক অভিযান চলমান রয়েছে। দ্রুতই ঘটনায় জড়িতরা আটক হবে। কোনো দেন দরবার কাজে আসবে না। অতিরিক্ত সোর্স লাগিয়ে অভিযুক্তদের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।

বেড়েছে ছিনতাই ও চুরি

শহরের বিভিন্ন স্থানে রাত নামলেই ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছে অনেক পথচারীকে। এসব ক্ষেত্রে আইনি ঝামেলা ও ভোগান্তির এড়াতে থানায় অনেকেই অভিযোগ দেন না। আবার অভিযোগ করেও তেমন লাভ হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন ছিনতাইকারীরা। গত শুক্রবার ভোরে শহরের সিটি কলেজপাড়ার বাসিন্দা শ্রমিক ইউনিয়নের সদ্স্য ইজিবাইক চালক সুশান্ত কুমারকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা।

এসময় তারা ইজিবাইকটিও ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। একই দিন রাতে শহরের মনিহার এলাকায় আবাসিক হোটেল কোকের নিচে পূর্ব বারান্দীপাড়ার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম নামে এক বিকাশ এজেন্টকে ছুরিকাঘাত করে দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী অজ্ঞাতদের নামে মামলা করলেও পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সভাপতি অধ্যক্ষ শাহিন ইকবাল বলেন, ‘যশোর শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নজিরবিহীন অবনতি ঘটেছে। দিনেও খুনখারাবি, ছিনতাই হচ্ছে। রাত নামলেই বাড়ছে আতঙ্ক। শহরের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতাও বেড়েছে। কিশোর-তরুণদের হাতে হাতে প্রাণঘাতী চাকু মিলছে।

অপরাধ দমনে পুলিশের তৎপরতা মোটেও আশ্বস্ত হওয়ার মতো নয়। তিনি বলেন, পুলিশের ঢিলেঢালা টহল, অপরাধ ঘটার পর পুলিশের দুর্বল চার্জশিট দাখিল ও আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণেও অপরাধ বেড়েছে। নিয়মিত টহল , কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা তালিকা করে চিরুনি অভিযানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকবে।’

জাগো/জেএইচ

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ