চার বছরে যশোরে এক হাজার ১১২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা

আরো পড়ুন

নিজস্ব প্রতিবেদক  
গত চার বছরে যশোরে এক হাজার ১১২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৪৮৭ টাকা। অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে যশোর জেলা প্রশাসন। ঢাকার অগ্নিকান্ডে ৪৬ জন মারা যাবার পর জেলার হোটেল রেস্তোরাঁসহ ৭৫৮টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিককে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। নোটিশে তাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি স্থাপন নিশ্চিত করে হালনাগাদ তথ্য ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অবহিত করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৩ মার্চ যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কমলেশ মজুমদার স্বাক্ষরিত এক নোটিশে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

নোটিশে বলা হয়, অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে জেলার ৮ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে থাকা আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন মালিক, বিপণী বিতান মালিক সমিতি, বাজার মালিক সমিতি এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় বিধি মোতাবেক অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি (ড্রাই পাউডার ফায়ার এক্সটিংগুইসার ও কার্বন-ডাই অক্সাইড ফায়ার এক্সটিংগুইসার) স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হলো।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স যশোরের উপসহকারী পরিচালক দেওয়ান সোহেল রানা জানান, জরুরি ভিত্তিতে অগ্নিঝুঁকি নিরসন ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে জেলার ৮ উপজেলার ৭৫৮ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিককে তাদের প্রতিষ্ঠানে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি স্থাপন নিশ্চিত করে হালনাগাদ তথ্য দিতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৬৬টি বাজার মালিক সমিতি, মার্কেট, সুপার মার্কেট ও শপিং মল ৮৭টি, হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৫০৫টি, বহুতল ভবন ৪৫টি এবং হোটেল রয়েছে ৫৫টি।

যশোর ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটেছিল ২৬১টি। যার আর্থিক ক্ষতি ছিল ২ কোটি ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৭ টাকা। ২০২১ সালে অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটেছিল ২৪৬টি। আর্থিক ক্ষতি ছিল ৫ কোটি ৭৬ লাখ ৩১ হাজার ৮শ টাকা। এবং গেল ২০২২ সালে যশোর জেলায় অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটেছিল ৩২২টি। যাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ২ কোটি ১১ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ২৮৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটে। যাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ২ কোটি ৭৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও ঘনবসতি এলাকায় বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটছে। আবার কিছু বহুতল ভবনেও আগুন লাগছে। তবে এসব বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপনের সক্ষমতা এখনও গড়ে উঠেনি ফায়ার সার্ভিস অফিসে। কেননা বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপনের জন্য যে টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) গাড়ি প্রয়োজন, সেটি তাদের নেই। একই সাথে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও পানি স্বল্পতা অগ্নি নির্বাপনে বড় অন্তরায় হয়ে উঠছে বলে মত দিয়েছেন ফায়ার সাভিস কর্মকর্তারা। তাদের মতে গত তিন বছরে জেলায় শতাধিক পুকুর বা জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে। এতে পানি স্বল্পতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

যশোর পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ সাজিয়া সুলতানা জানান, গত তিন বছরে আড়াই শতাধিক ভবন অনুমোদন দিয়েছেন তারা। ৬ তলা পর্যন্ত ভবন অনুমোদন দিয়ে থাকে পৌরসভা। সেখানে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে কি পরিমাণ পুকুর বা জলাশয় ভরাট হচ্ছে তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। কেননা রাতারাতি সবাই পুকুর ভরাট করে ফেলছে।

পুকুর ভরাট করতে হলে অবশ্যই পৌরসভার অনুমোদন লাগবে বলে জানান, পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফ হাসান। কেউ অনুমোদন বিহীন জলাশয় ভরাট করলে তাদের বিরুদ্ধ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানান।

এব্যাপারে যশোর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সহকারী পরিচালক মো: মামুনুর রশীদ জানান, গত চার বছরে যশোরে এক হাজার ১১২টি অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটেছে। এতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ১৩ কোটি ২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৪৮৭ টাকা। আমরা যেখানে অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটে সেখানে ছুটে যায়। তবে শহরের বড় বাজার, কালেক্টরেট মার্কেটসহ অনেক বহুতল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ঘন বসতি এলাকায় আমাদের গাড়ি প্রবেশ করতে পারেনি। বিকল্পভাবে যেতে হয়, তখন ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে। তিনি জানান, আগুন নেভানোর জন্য পানি প্রয়োজন হয়ে থাকে। আমাদের গাড়িতে যে পরিমাণ পানি থাকে তা দিয়ে চেষ্টা করা হয়। তবে গাড়ির পানি ফুরিয়ে গেলে পানি পাওয়া যায়না। গত তিন বছরে জেলায় শতাধিক পুকুর বা জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে বলে জেনেছি। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। কেননা এভাবে পুকুর ভরাট হয়ে গেছে অগ্নিকান্ড ঘটলে সেটা সামাল দেয়া কষ্টকর ব্যাপার। আবার বহুতল ভবনে রমালিকরা অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রাখেনা। সেটাও পীড়াদায়ক।

এব্যাপারে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মো: ছোলজার রহমান জানান, যশোর ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা রয়েছে ৪ তলা পর্যন্ত আগুন নেভানোর। কিন্তু শহরে ৮-১৪ তলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। আবার সরকারি বেসরকারি পুকুর জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আবার নদীগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। সেখান থেকে পানি পাওয়া যাবেনা। পৌরসভাগুলো যেসব বাড়ি অনুমোদন দিচ্ছে সেখানে চওড়া রাস্তা রাখছেনা। ফলে অগ্নিকান্ডের ঘটণা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের কিছু করা থাকছেনা। কারণ তারা গাড়ি নিয়ে সেখানে যেতে পারছেনা। এতেই প্রতিবছর অগ্নিকান্ডে ক্ষতির হার বাড়ছে। অগ্নিকান্ড থেকে বাঁচতে পরিকল্পিতভাবে নগরায়ন গড়ে তুলতে হবে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এরইমধ্যে যশোর পৌর এলাকার হোটেল সিটি প্লাজা, হাসান ইন্টারন্যাশনাল, কাপুড়িয়াপট্টির হোটেল নয়ন, হোটেল চৌধুরী, হোটেল ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল, রেলবাজারের হোটেল শাহানাজসহ শতাধিক আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন মালিক, বিপণী বিতান মালিক সমিতি, বাজার মালিক সমিতি এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যশোরের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে হাতের কাছে ফায়ার এক্সটিংগুইসার রাখতে ব্যাপক সচেতনতা ছাড়া এমন দুর্ঘটনা মোকাবিলা করা কঠিন। শুধু ফায়ার সার্ভিস এই সংকট মোকাবিলা করতে পারবে না। এর জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় প্রশাসন, পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, অগ্নিনির্বাপণে জলাধার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যশোরের বড়বাজার, কালেক্টরেট মার্কেটসহ একাধিক মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে। আমরা বিষয়টি জেলা প্রশাসনের সভায় এসব তথ্য বলেছি। শহরের মার্কেটগুলোর আশপাশে কোনো জলাধার নেই। তিনি এ বিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

জাগো/জেএইচ

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ