অধ্যাপক ফারুক হোসাইন ছিলেন আদর্শের আলোকবর্তিকা

আরো পড়ুন

মৃত্যু চিরসত্য। মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই পৃথিবীতে আসে। তাই মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মৃত্যু মানে দুঃখ। মৃত্যু মানে কষ্ট, যন্ত্রণা এবং সীমাহীন বেদনা। তবে কিছু কিছু মৃত্যু মেনে নেওয়া এতটাই কষ্টকর আর হৃদয়বিদারক যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে শিক্ষকেরও কি মৃত্যু হয়? আমার মনে হয় না। ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু শিক্ষক বেঁচে থাকে তাঁর অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর মনের মাঝে, কর্মের মাঝে, কৃতিত্বের মাঝে, সফলতার মাঝে। শিক্ষক মানে ম‚লত জীবনের পথপ্রদর্শক, অন্ধকার পথের আলোকবর্তিকা। ঠিক সে অর্থেই স্যার ছিলেন এক অনবদ্য আলোকবর্তিকা। বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ড. ফারুক হোসাইন স্যারের কথা।

ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের জীবনে শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে ভালোলাগার কিছু শিক্ষক থাকেন, যাদের দিকনির্দেশনা, শিক্ষাদানের পদ্ধতি, স্নেহ-ভালোবাসা মনে আলাদা করে দাগ কাটে। তাদের বলা হয়ে থাকে ‘প্রিয় শিক্ষক’। এমন অনেক শিক্ষকের মধ্যে একজন অধ্যাপক ফারুক হোসাইন। প্রয়াত এই মানুষটি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী। তাই জীবন থেকে ছুটি নিলেও আমাদের অন্তরে এখনও বেঁচে আছেন স্বমহিমায়।

দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন চিরতরে। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল। প্রিয় শিক্ষকের আকস্মিক মৃত্যুতে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত উনার হাজারো শিক্ষার্থী, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সেদিন শোকে মুহ্যমান ছিলেন।

ডিপার্টমেন্টের করিডোরে স্যারের আর সেই সদর্পে বিচরণ নেই। ক্লাসে দুষ্টামির জন্য দরাজ কণ্ঠে আওয়াজ শোনা যায় না। যার আওয়াজ শুনলে অন্যান্য ক্লাসের ছাত্ররা পর্যন্ত চুপসে যেত। জীবনমুখী উপদেশগুলো আর শোনা হবে না। যিনি তার শিক্ষকতা জীবনে তার ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন নিরবিচ্ছিন্নভাবে। তাঁর মতো নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানের ভাণ্ডারসমৃদ্ধ শিক্ষক যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন না। সমাজকর্ম বিভাগ যাকে হারিয়েছি তার শূন্যত্য অপূরণীয়।

এটিই বাস্তব যে, জীবন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলে সবাইকে ভাবতে হয় তার অতীত জীবনের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে। কেন তিনি এসেছেন এ পৃথিবীতে। আর কতটাই বা সফল হয়েছে তার এই আগমনের উদ্দেশ্য? যুগে যুগে অনেক মনীষী এসেছেন এ ধরিত্রীকে আলোকিত করতে। তেমনি এক জাগ্রত বিবেকের মানুষ ছিলেন অধ্যাপক ফারুক হোসাইন।

স্বচ্ছ দায়িত্ববোধ, সুন্দর আচরণ, উত্তম আদর্শ, আর উন্নত ব্যক্তিত্বের মধ্যেই নিহিত ছিল তাঁর মহত্ব এবং কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, অ্যাকাডেমিক অসততা করলে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। তিনি কখনো কোনো ক্লাসে এক মিনিট দেরি করে গেছেন অথবা অ্যাকাডেমিক অন্য কাজে সামান্যতম গাফিলতি করেছেন এমনটা দেখিনি। আমাদের সবসময় তিনি শিখিয়েছিলেন সময়ের কাজ সময়ে না করতে না পারাটা এক ধরনের অন্যায়। স্যারের মৃত্যুতে আজ অবধিও মনটার মধ্যে বেশ শ‚ন্যতা ও বিষন্নতা অনুভব করি। এই মানুষটি সদা হাস্যোজ্জ্বল এবং পুরাদ্থর অমায়িক একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আমি কখনোই স্যারকে ক্লাসরুম কিংবা ক্লাসরুমের বাইরে রাগতে দেখিনি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, আচার-ব্যবহার, সফলতায় অসংখ্য শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি নিঃসন্দেহে একজন আইডল ছিলেন। ক্লাসরুম এবং ক্লাসরুমের বাইরে স্যার শিক্ষার্থীদের কাছে অসাধারণ একজন অভিভাবক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

তবে বিদায়বেলায় স্যারকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবেগঘন হাজারো স্ট্যাটাস, অশ্রুসিক্ত আহাজারি, সহকর্মীদের কান্নাভেজা স্মৃতিচারণ এসবই জানান দিয়েছিল কতটা আদর্শ শিক্ষক ছিলেন তিনি। এইদিক থেকে পৃথিবীতে তাঁর আগমন সার্থক।

বর্তমান সময়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে নানাবিধ নেতিবাচক কথা শোনা গেলেও এই দু’দলের সম্পর্ক শ্রদ্ধা আর স্নেহের পরশে মাখা যুগ যুগান্তরের। আমার সামান্য শিক্ষাজীবনে অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরুর স্নেহে ধন্য হয়েছি। তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর স্নেহে জীবনকে ভরিয়েছি। কিছু কিছু সম্পর্ক সময়ের পরিক্রমায় ফিকে হয়ে যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ক আজীবন মনের আকাশে উজ্জ্বল থেকে স্মৃতির মনিকোঠায় আলো ছড়ায়। ফারুক স্যারের সঙ্গে আমার তেমনই এক পিতা-পুত্রের স্নেহময় আত্মিক সম্পর্ক, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের চারদেয়ালে আটকে ছিল না বরং তার পরশ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।

স্যার বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল তার হাজার হাজার প্রিয় ছাত্রদের মনে, যাদেরকে তিনি শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে গেছেন। নিজেকে নিবেদিত করেছেন মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বকে বিকশিত করার কাজে। যারা তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছেন তারাই কেবল অনুধাবন করতে পেরেছেন।পরপারে মহান আল্লাহ যেন আমাদের প্রিয় স্যারকে জান্নাতের সর্বোচ্চ আসন দান করেন এই দোয়া করি। আমিন।

লেখক: কামরুল হাসান অভি, শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরো পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বশেষ