নিজস্ব প্রতিবেদক
জন্মগতভাবে হাত ছাড়া মাত্র একটি পা নিয়েই দুনিয়ায় আসে তামান্না নূরা। তবে ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে হার মেনেছে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা। কেউ মমতায়, কেউ বা করুণার চোখে তাকায় তার দিকে। কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কৃতিত্ব অর্জন করেছেন জীবনের সব পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার। শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে পড়ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপরের গল্পটা শুধুই তার এগিয়ে যাওয়ার। শুধু তামান্না নয়, যশোরে অসংখ্যা প্রতিবন্ধীর ভিড়ে তার মতো আরও আছেন শাহেদা, লিতুন জিরা, জ্যোতিদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। শারিরিক প্রতিবন্ধী হয়েও নিজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার সংগ্রামে লিপ্ত এই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন পড়ালেখায়, সাহিত্য চর্চায়।
পা-ই তামান্নার ‘স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার’
২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। তামান্নার বাবা রওশন আলী যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার দাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদ্রাসার (ননএমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না সবার বড়। ছয় বছর বয়সে তামান্নাকে পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করে তার পরিবার। সেখান থেকে তার ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে মাত্র দুই মাসের মাথায় পা দিয়ে লিখতে শুরু করে। এরপর ছবি আঁকা শুরু করে তামান্না। তার আঁকা অনেক ছবি ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠিয়েছেন তামান্না। ২০২১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পরে গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাসহ দুটি স্বপ্নের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তামান্না। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিও কলে ফোন দিয়ে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা। একই সঙ্গে দুই বোন তামান্নার স্বপ্নপূরণে যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন। বর্তমানে তামান্না যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করছেন। যে পা দিয়ে তামান্না বিশ্ব জয় করার স্বপ্ন দেখছেন, সেই পা দিয়ে সম্প্রতি তিনি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা বই ‘ইচ্ছার আলো’। তামান্না আক্তার নুরা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। শারীরিক অক্ষমতা কখনো স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না। স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, একদিন বাস্তবায়নও হবে।
প্রতিবন্ধিতাজয়ী শাহিদা
১৯৯১ সালে একটি হাত ও দুটি পা ছাড়াই জন্ম নেয় শাহিদা। বিকলাঙ্গ (প্রতিবন্ধী) হওয়ায় অন্য বাচ্চারা তার কাছ থেকে দূরে থাকতো। সে এক নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করতো। তার সহপাঠী ও সমবয়সীরা পায়ে ভর দিয়ে দৌড়াতো, খেলতো, নাচতো, ছুটতো, সাঁতার কাটতো। কিন্তু এর কোনোকিছুই যখন সে করতে পারতো না, তখন সে মনস্থির করে তার জীবনকে অন্যভাবে গড়ে নিতে হবে। তখন সে পড়ালেখা শুরু করে দেয়। এরপর একটি মাত্র হাত (বাম হাত) দিয়েই অর্জন করেছেন দেশের সর্বচ্চো একাডেমিক ডিগ্রী স্নাতকোত্তর। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) সাবেক সভানেত্রী জীশান মীর্জার সহযোগিতায় আকিজ গ্রুপে চাকরিতে যোগদান করেছেন। নওয়াপাড়াতে আকিজ জুট মিলে অ্যাডমিন বিভাগের এক্সিকিউটিভ কর্মকর্তা পদে যোগদান করেছেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা অদম্য এই তরুণী। শাহিদার বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। মুদি দোকানি রফিউদ্দিনের ছয় সন্তানের মধ্যে শাহিদা চতুর্থ। জন্ম থেকেই দুটি পা আর একটি হাত না থাকলেও সচল বাকি হাত দিয়েই বাঁচার স্বপ্ন দেখেন শাহিদা খাতুন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে অনন্য নজির স্থাপন করেন এলাকায়। শাহিদা প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে ২০১৫ সালে যশোর সরকারি এম এম কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স পাস করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি শাহিদা হ্যান্ডিক্রাফট, সেলাইসহ বিভিন্ন হাতের কাজও করতে পারেন। নিজে প্রতিবন্ধী হয়েও অন্য প্রতিবন্ধীদের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। বাড়ির পাশে গড়ে তোলেন সৃষ্টিশীল নারী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা। এখান থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা আর নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে করেছেন আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
কোনো বাধাই দমাতে পারেনি জ্যোতিকে
তার হাত-পাসহ পুরো শরীর অবশ বা পক্ষঘাতগ্রস্ত। শুধু মুখ দিয়ে কথা বলতে পারেন। আর এভাবেই মুখ দিয়ে বলে শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে জীবনের সকল পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন অদম্য মেধাবী জ্যোতি হোসেন। ঝিকরগাছা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের আব্দুল খালেক এবং রেক্সোনা হোসেন দম্পতির বড় মেয়ে এই জ্যোতি হোসেন। বর্তমানে জ্যোতি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর দশটা শিশুর মতোই স্বাভাবিক ছিল তার জীবন। ২০০৭ সালে একটি দুর্ঘটনা তার সব স্বপ্ন ওলটপালট করে দেয়। নানাবাড়ি থেকে ফেরার পথে ভ্যানের চাকার সঙ্গে ওড়না জড়িয়ে গলায় ফাঁস লেগে তার পুরো শরীর প্যারালাইজড হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও ডাক্তাররা তাকে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারেননি। জ্যোতির মা রেক্সোনা হোসেন বলেন, আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী। অসুস্থ হওয়ার পরও সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছে। তার স্বপ্ন পূরণে প্রতিবন্ধীকতা বাঁধা হিসাবে আসেনি।
মুখে ভর দিয়ে লিখেই অদম্য লিতুন জিরা
জন্ম থেকেই লিতুন জিরার (১৪) দুটি পা নেই। দুই হাতও নেই কনুইয়ের ওপর থেকে। তবু লেখাপড়ার অদম্য চেষ্টা মেয়েটির। লেখার জন্য ডান হাতের বাহুর আগা দিয়ে কলম চেপে ধরে চোয়ালে। এভাবে লিখেই এবার সে বসেছিল নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায়। কৃর্তিত্বের সঙ্গে করেছেন ফলাফলও। স্থানীয় গোপালপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণী হয়েছে শ্রেণী ফাস্ট। এর আগেও পিএসসি, জেএসসিতেও পেয়েছিলেন বৃত্তি। লিতুন জিরা যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শেখপাড়া খানপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে। বাবা হাবিবুর রহমান জানান, দুই হাত ও পা ছাড়াই লিতুন জিরা জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতেন তারা। এখন মেয়ের মেধা তাদের আশার সঞ্চার করছে। লিতুন জিরা আর দশজন শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবেই খাওয়া-দাওয়া, গোসল সব কিছুই করতে পারে। মুখ দিয়েই লিখে সে। তার চমৎকার হাতের লেখা যে কারও দৃষ্টি কাড়বে। লিতুনের একটাই ইচ্ছা, পরনির্ভর না হয়ে লেখাপড়া শিখে নিজেই কিছু করতে চায় সে। পড়াশোনার পাশাপাশি অদম্য এই কিশোর খুলনা বেতারে গান ও কবিতা আবৃত্তির নিয়মিত শিল্পী। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পেয়েছেন শেখ রাসেল পদকও।
যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ‘যশোরে অনেক শারিরিক প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই আছে নিজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে হার মেনেছে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সব বাধা পেরেয়ে তাদের আছে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। জেলার সকল প্রতিবন্ধীদের জেলা প্রতিবন্ধী অফিস ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হচ্ছে, যাতে তাদের পথচলা বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।’
জেবি/জেএইচ