২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই আট মাসে ৩৬১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এতে প্রতি মাসে গড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫.১৩ জন। দেশে প্রকাশিত ১০৫ টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে সংগৃহীত তথ্য জরিপ করে এ সংখ্যার কথা জানিয়েছে আঁচল ফাউন্ডেশন।
২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা আঁচল ফাউন্ডেশন ধারাবাহিকভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা জরিপ করে থাকে। তাদের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছরই বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। ২০২২ সালে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল যা মাসে গড়ে ৪৪.৩৩ জন। আর ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০১ জন যা মাসে গড়ে ৮.৪১ জন।
শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে আঁচল ফাউন্ডেশন আত্মহত্যা জরিপের তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরে। ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান’ শীর্ষক ওই সমীক্ষায় তারা জানায় তরুণ প্রজন্মের অনেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহননকে একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হাইওয়ে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম, এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
গত আট মাসে গড়ে প্রায় ৪৫.১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। যেখানে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩০ জন। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে পুরুষ শিক্ষার্থী ছিলো ১৪৭ জন। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থী ছিলো ২১৪ জন। একই সময়ে ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছিল ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী।
২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে আর সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। ঢাকায় আত্মহত্যা করেছে ৩১.৩০ শতাংশ আর সিলেটে ২.৫ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগ ১৪.১০ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১.৯০ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ শতাংশ, রংপুরে বিভাগে ৮.৯০ শতাংশ, এবং বরিশালে আত্মহত্যা করেছে ৮.৩০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ঢাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় এখানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।
জরিপে দেখা গেছে ছেলেদের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করেছেন। ৩৬১ জনের মধ্যে ৫৯.৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে। অপরদিকে ৪০.৭০ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন অভিমানে ২৬.৬০ শতাংশ। দ্বিতীয় কারণ প্রেমঘটিত ১৮.৭০ শতাংশ। আর তৃতীয় কারণ পড়াশুনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২.৬০ শতাংশ। এছাড়া মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮.৪০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯.৮০ শতাংশ, ৫.১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬.৮ শতাংশই স্কুলগামী। এদের মাঝে নারী শিক্ষার্থী ১১২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৫৭ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মাঝে কলেজগামী শিক্ষার্থী ২৬.৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ১৮.৩০ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মাঝে মাদরাসার শিক্ষার্থী ৮.৩১ শতাংশ।
আত্মহত্যাকারীদের বয়স ভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায় সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা যা শতকরা ৬৭.৩ শতাংশ। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ১৫৯ জন আর পুরুষ শিক্ষার্থী ৮৪ জন। এরপর ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১.৬ শতাংশ। আর ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২.৮০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ৮.৩০ শতাংশ।
আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা অভিমানে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে, প্রেম ঘটিত জটিলতা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, পড়াশোনার চাপ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক সমস্যা এবং অন্যান্য।
অভিমান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১১৪ জন অর্থাৎ ৩১.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। সমান সংখ্যক ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থী অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন।
প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৫.৮০ শতাংশ। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৬.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১১.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩.৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৪.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন একাডেমিক চাপের কারণে।
আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার কারণে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কম হওয়ার ধারণা থাকলেও দেখা গেছে গত আট মাসে ৩০ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যার প্রধান কারণ অভিমান। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫৩.৩০ শতাংশ আর পুরুষ শিক্ষার্থী ৪৬.৭০ শতাংশ। অভিমান ছাড়াও রোমান্টিক সম্পর্কের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১৩.৩০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের আত্মহত্যার পিছনে যৌন নির্যাতন দায়ী।
সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট তানিসেন রোজ বলেন, এর আগের আত্মহত্যার ডাটা বিশ্লেষণে আত্মহত্যার পিছনে প্রেমঘটিত সম্পর্কের দায় বেশি দেখা গেলেও এবার আত্মহত্যার পিছনে মূল ভূমিকা রাখছে অভিমান। এর ফলে পরিবারের সাথে সন্তানদের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তার উদ্রেক করে। গতবছর আত্মহত্যার পিছনে বোশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর বড় ভূমিকা ছিল। এ বছর করোনা না থাকলেও আত্মহত্যার সংখ্যায় খুব একটা হেরফের হয়নি যা আশঙ্কার।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে বলেন, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে নিবৃত করতে আমাদের উচিত তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মনোযোগী হওয়া। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দায়িত্বশীল হতে হবে যেন তারা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হতে পারেন।
অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন আত্মহত্যার পিছনে বর্তমান প্রজন্মের একাকী থাকাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এখনকার প্রজন্ম খুব একা থাকতে পছন্দ করে এবং তারা খুব একাকিত্বে ভোগে। তাদের মধ্যে একাকিত্ব থেকে শূন্যতা, শূন্যতা থেকে হতাশা, এবং পরবর্তীতে তারা নিজেদেরকে বোঝা মনে করে। তাদের মধ্যে দেখা যায় পারস্পরিক সম্মান থাকে না। তখনই তারা এ ধরনের পথের আশ্রয় নিতে পারে। ওই একাকীত্বের সময়ে হাতের কাছে তখন সাহায্য করার মতন কেউ থাকে না, তখন যদি আমরা তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তাহলে কিন্তু তাকে ওই জায়গা থেকে বের করে আনা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শহীদুল ইসলাম আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের কথা জানিয়ে বলেন, আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার প্রচেষ্টা প্রতিরোধ বিষয়টিকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়ন্ত্রিত অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কম্পোনেন্ট হিসাবে বিবেচনা করে। আগামী অর্থবছর থেকে বাস্তবায়নযোগ্য ৫ম এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামের আওতায় সরকার এই প্রথমবারের মত একটি ডেডিকেটেড অপারেশনাল প্ল্যান ‘মেন্টাল হেলথ এন্ড ডিসএ্যাবিলিটি (এমএইচডি)’ অনুমোদন করতে যাচ্ছে। যেখানে আগামী ৫ বছরের মানসিক স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত আত্মহত্যা ও এর প্রচেষ্টা প্রতিরোধে অত্যাধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হাতে নেয়া হচ্ছে। যার সুফল দেশবাসী অচিরেই উপভোগ করবেন।
সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। এগুলোর মধ্যে আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু, শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো, গণমাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করা। যথাসম্ভব আত্মহত্যার বিস্তারিত বিবরণ ও ধরন বর্ণনা থেকে বিরত থাকা, তিনমাস পরপর শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি।